মাসুদ রানা রাব্বানী, রাজশাহী: রাজশাহীর নগরীর মোল্লাপাড়া
এলাকার শত বছরের পুরনো সাঁওতাল পল্লী এখন বিলুপ্তির পথে।
ভূমিদস্যুদের থাবায় এই আদিবাসী জনপদ তাদের পৈতৃক ভিটা
হারাতে বসেছে।
ইতোমধ্যে বেশ কয়েকটি পরিবার বাড়িঘর ভেঙে
অন্যত্র সরে গেছে এবং বাকি পরিবারগুলোও চরম আতঙ্কে দিন
কাটাচ্ছে।
অভিযোগ উঠেছে, স্থানীয় প্রভাবশালী সাজ্জাদ আলী প্রায় শত
কোটি টাকা মূল্যের এক বিঘার বেশি জমি দখলের চেষ্টা করছেন,
যার ফলস্বরূপ আদিবাসীদের উচ্ছেদ করা হচ্ছে।
মোল্লাপাড়ার এই সাঁওতাল পল্লীতে প্রায় ১০০ বছর ধরে আদিবাসী
পরিবারগুলো বসবাস করে আসছে।
জানা যায়, ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় ভারতে পালিয়ে
যাওয়া ইন্দ্রা ধুবা নামের এক হিন্দু সম্প্রদায়ের ব্যক্তি এই
আদিবাসীদের তার জমিতে আশ্রয় দিয়েছিলেন। সেই থেকে তারা
শান্তিতেই বসবাস করে আসছিলেন। কিন্তু গত ৮-১০ বছর ধরে
নগরীর চারখুটা মোড়ের বাসিন্দা সাজ্জাদ আলী এই জমিটি
কিনে নিয়েছেন দাবি করে আসছেন এবং দখলের চেষ্টা চালাচ্ছেন।
আদিবাসীদের অভিযোগ, সাজ্জাদ আলী বারবার জমি কেনার দাবি
করলেও স্থানীয় কাউন্সিলরের সালিশ বৈঠকে তিনি কখনো বৈধ
কাগজপত্র দেখাতে পারেননি। কিন্তু গত তিন-চার মাস ধরে স্থানীয়
কয়েকজন প্রভাবশালীকে হাত করে সাজ্জাদ আলী প্রায় সব প্রক্রিয়া
সম্পন্ন করেছেন এবং আদিবাসীদের উচ্ছেদ করার হুমকি দিচ্ছেন।
আদিবাসীদের বলা হয়েছে, জমি ছেড়ে স্বেচ্ছায় চলে গেলে ১৬টি
পরিবারকে ৩১ লাখ টাকা দেওয়া হবে। ভয়ে কিছু পরিবার এই শর্তে
রাজি হয়েছে এবং টাকাও গ্রহণ করেছে। আগামী শুক্রবারের মধ্যে
বাকি পরিবারগুলোকেও জায়গা ছেড়ে দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া
হয়েছে।
মঙ্গলবার দুপুরে সরেজমিনে মোল্লাপাড়া সাঁওতাল পল্লীতে গিয়ে
দেখা যায়, আদিবাসী নারীরা একত্রিত হয়ে কথা বলছেন। তাদের
চোখে-মুখে ঘর হারানোর ভয় ও আতঙ্কের ছাপ স্পষ্ট। একজন
আদিবাসী নারী বলেন, আমরা অসহায় মানুষ, কেমন থাকবো ?
আমাদের এই ভিটা এখন ছেড়ে দিতে হচ্ছে। আমাদের কাগজ নেই
বলে আমরা ভয়ে কারো কাছে বিচার চাইতেও পারছি না। যিনি
কিনেছেন, তিনিও এতদিন কাগজ দেখাতে পারেননি। এখন হঠাৎ
করে নাকি কাগজ করেছেন আর সেই কাগজ দেখিয়েই আমাদের
তাড়ানো হচ্ছে।
মালতি বিশ্বাস নামের আরেকজন বলেন, আমার স্বামীর বাপ-দাদারা
এই জায়গায় থাকতেন। সেই সূত্রে আমরা এখানে বসবাস করি।
আমরা গরিব মানুষ, ভয়ে কারো কাছে বিচার চাইতেও যেতে
পারছি না। আগে কাউন্সিলর সমাধান করে দিতেন, এখন কোনো
কাউন্সিলরও নেই। তাই সাজ্জাদ কিছু টাকা ধরিয়ে দিয়ে
ইচ্ছামতো জায়গাটি দখল করছে। আমরা এই ভিটা ছাড়তে চাই
না।
শান্ত বিশ্বাস নামের একজন বলেন, এতদিন পরে কিভাবে সাজ্জাদ এই
জায়গার কাগজ করলেন, তা কেউ বুঝে উঠতে পারছে না। তারপরও
আমরা অসহায় হয়ে এখান থেকে চলে যেতে বাধ্য হচ্ছি।
স্থানীয়দের অভিযোগ, সাজ্জাদ আলী একসময় ছোট একটি মুদির
দোকানের ব্যবসায়ী ছিলেন। কিন্তু তিনি মোল্লাপাড়া সাঁওতাল
পল্লীসহ প্রায় ৬০ থেকে ৭৯ বিঘা হিন্দুদের জমি অবৈধভাবে দখল
করেছেন, যার আনুমানিক মূল্য প্রায় ৫০০ কোটি টাকা। এত
বিপুল পরিমাণ জমির মালিক তিনি কিভাবে হলেন, তা নিয়ে
স্থানীয়দের মধ্যে সন্দেহ সৃষ্টি হয়েছে।
স্থানীয় পালন নামের একজন বলেন, ্য়ঁড়ঃ;সাঁওতাল পাড়ার পাশেই আমারও
তিন কাঠা জমি জোর করে দখলে রেখেছে সাজ্জাদ আলী। এভাবে
তিনি এখন ৭০-৮০ বিঘা সম্পত্তির মালিক। অথচ তার মা মানুষের
বাড়িতে কাজ করে খেতেন।্য়ঁড়ঃ;
এ বিষয়ে জানতে চাইলে সাজ্জাদ আলী বলেন, আমি জমিটি
কিনেছি ৩০-৩২ বছর আগে। তাই দখল করছি না। আমার জমি
আমি বুঝে নিচ্ছি। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এতদিন
পারেনি আমার কাছে নগদ টাকা ছিল না। ওদেরকে ক্ষতিপূরণের জন্য
কিছু টাকা দিতে হলো তাই এখন করছি। তবে তিনি কাউন্সিলরের
দরবারে কখনো বসা হয়নি বলেও দাবি করেন।
এ ব্যপারে স্থানীয় সাবেক ওয়ার্ড কাউন্সিলর ও জামায়াতে ইসলামীর
নেতা নোমান আলী সাজ্জাদ আলীর দাবি অস্বীকার করে বলেন, ওই
জমিটা নিয়ে কয়েক দফা আমার অফিসে বসা হয়েছে। কখনোই
সাজ্জাদ আলী তিনি কাগজ দেখাননি। তবে বারবার তিনি
জায়গাটি কিনেছেন বলে দাবি করেছিলেন। আমরা কোনোভাবেই
ওই জায়গাটি দখল করতে দেইনি। হিন্দুর সম্পত্তি কিভাবে তিনি
কিনলেন, সেটি নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে।
এ ঘটনায় আদিবাসী পরিবারগুলোর ভবিষ্যৎ নিয়ে চরম অনিশ্চয়তা
দেখা দিয়েছে। সরকারি কোনো নির্দেশনা ছাড়াই শুধুমাত্র ব্যক্তি
প্রভাবে শত বছরের এই আদিবাসী পল্লী উচ্ছেদ হওয়ায় স্থানীয়দের
মধ্যে ক্ষোভ ও হতাশা বিরাজ করছে বলেও জানান তিনি।